ঘরের যে দেয়ালগুলো কয়লার কালির আস্তরণে কালো হয়ে যেত, সেগুলো এখন কত সফেদ, সুন্দর! সেখানে থরে-বিথরে কত সাফল্যের ছবি সাঁটানো। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফি নেই বলে দেয়ালের উজ্জ্বলতা যেন ঠিক পূর্ণতা পায় না। এদিকে প্রাপ্তির ক্যানভাসে পূর্ণতার ছবি আঁকার সময়ও যে ফুরিয়ে আসছে আনহেল দি মারিয়ার!
দেব দেব করে গত মে মাসে ঘোষণাটা তিনি দিলেন- বিশ্বকাপ দিয়েই শেষ। জানালেন, কাতারের আসরের পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে তুলে রাখবেন প্রিয় বুটজোড়া। মরুভূমির আসরও শেষের দুয়ারে দাঁড়িয়ে। রোববার লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনালে ফ্রান্সের মুখোমুখি তার দল আর্জেন্টিনা। ‘লাস্ট চান্স’কে ‘লাস্ট ড্যান্স’-এ রূপ দিতে পারবেন তো দি মারিয়া?
প্রশ্নটা উঠছে তার ঊরুর সমস্যার কারণে। গত অগাস্ট থেকে যা ভুগিয়ে চলেছে তাকে। দোহাতে এসেও এই চোট পিছু ছাড়েনি। গ্রুপ পর্বে কেবল সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচে পুরো নব্বই মিনিট খেলেন তিনি। মেক্সিকো ও পোল্যান্ড ম্যাচে যথাক্রমে ৬৯ ও ৫৯তম মিনিট। পোল্যান্ড ম্যাচেই ঊরুতে ফের থাবা বসায় চোট।
শেষ ষোলোয় অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে তাই দি মারিয়াকে পাওয়া নিয়ে জমেছিল অনিশ্চয়তা। শঙ্কার মেঘ সরিয়ে তিনি অনুশীলনে ফিরেন বটে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাকে বেঞ্চে রাখেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। বদলি হিসেবেও খেলাননি। কোয়ার্টার-ফাইনালে নেদারল্যান্ডস ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয় অর্ধে বদলি নামেন, খেলেন মাত্র ৮ মিনিট, কিন্তু ছাপ রাখতে পারেননি সেভাবে।
এরপর ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেরা চারের লড়াইয়ে আবারও তার জায়গা হয় বেঞ্চে। যদিও সৃষ্টিশীল এই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে ছাড়াই আক্রমণের ঝড় তুলে ক্রোয়াটদের ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয় মেসি-আলভারেসরা। দলের জয়ে মেতে ওঠেন দি মারিয়াও। কিন্তু কোনো অবদান রাখতে না পারার আক্ষেপ একটু হলেও কি উঁকি দেয় না তার মনের গহীনে?
নিজে না খেললেও ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে জয়ের উৎসব করেছেন দি মারিয়া। কিন্তু আট বছর আগে ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়েছিল তার। চোটের কারণে খেলতে না পারার হতাশায় ডুবেছিলেন, কেঁদেছিলেন। জার্মানির কাছে অতিরিক্ত সময়ের গোলে আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ায় এত কাছে এসেও বিশ্বকাপ জিততে না পারার ব্যর্থতায় দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলেন। লুসাইলে খেলতে নিশ্চয় মারাকানার ফাইনালের আগের কিংবা সেই ছোট বেলার মতোই ছটফট করছেন দি মারিয়া।
রোসারিওর সান্তে ফের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘর আলো করে তার আসার দিনটি ছিল আনন্দের, ভালোবাসার রঙে রাঙানো। ১৪-ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে। দিন গড়ায় শিশুটি হাটি-হাটি পা-পা করে বড় হয়। লিকলিকে, রোগাপকটা গড়ন, কিন্তু দুষ্টের শিরোমণি! সারাক্ষণ দস্যিপনায় মাতিয়ে রাখে বাড়ির উঠান, চারপাশের ফুটপাত, বাড়ির লাগোয়া দোকানের সামনের রাস্তাটা। মাঝেমধ্যে বাবার কয়লা বানানোর কাজেও হাত লাগায় বোনদের সঙ্গে। এবং ফুটবল খেলে।
বল পায়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রোসারিও সেন্ট্রালে মাথা গুঁজতে পারে কিশোরটি। এরপর বেনফিকা ঘুরে রিয়াল মাদ্রিদে আলো ছড়িয়ে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে কঠিন সময় পেরিয়ে নোঙর ফেলেন পিএসজিতে। প্যারিসে আলো ছড়িয়ে বর্তমানে খেলছেন ইউভেন্তুসে। সেরি আ‘র এই দলটির হয়ে অগাস্টে অভিষেকও জয় দিয়ে। কিন্তু ওই ম্যাচে পাওয়া ঊরুর চোট নাছোড়বান্দার মতোই প্রায় উঁকিঝুঁকি দেয়, দি মারিয়ার স্বপ্ন পূরণের পথ আগলে দাঁড়াতে চায়।
আলবিসেলেস্তে সমর্থকদের জন্য অবশ্য স্বস্তির খবর, ফাইনালের আগে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেন দি মারিয়া। ফরাসিদের বিপক্ষে যুদ্ধ জয়ে পুরো শক্তির দল পাওয়ার আশা করছেন স্কালোনিও। শুক্রবার রুদ্ধদ্বার অনুশীলন করেছে আর্জেন্টিনা। পথের শেষে এসে পৌঁছানো দি মারিয়াকে নিয়ে হয়ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোচ নিবেন শেষ মুহূর্তে।
কিন্তু দি মারিয়ার যে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার সময় নেই। আর্জেন্টিনার হয়ে এরই মধ্যে ১২৭ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন, ফরোয়ার্ডদের আক্রমণের সুর বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি গোলও করেছেন ২৭টি। কিন্তু আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে প্রাপ্তি বলতে ২০০৮ সালের অলিম্পিকসের ফুটবল ইভেন্টের সোনা আর সবশেষ ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার ট্রফি জয়। বিশ্বকাপ এখনও অধরা সোনার হরিণ।
২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। কিন্তু সাত বছর বাদে এই মিডফিল্ডারের একমাত্র গোলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার ২৮ বছরের খরা কাটানোর গল্প লিখেছিল আর্জেন্টিনা। এবার তারা বিশ্বকাপের আঙিনায় চলা ৩৬ বছরের হাহাকার ঘোঁচাতে উন্মুখ।
মুখিয়ে আছেন দি মারিয়াও। লুসাইলের ফাইনালে যদি খেলার সুযোগ মিলে, বলার অপেক্ষা রাখে না, বল পায়ে শেষ নৃত্যে মেতে উঠতে মরিয়া থাকবেন তিনি। মারাকানার ফাইনালের আগে-পরে কেঁদেছিলেন হতাশায়। এবার আগেভাগে বিদায়ের রাগিনী বাজিয়ে এসে এমনিতেই ভারি করে তুলেছেন চারপাশ, কিন্তু বিশ্বজয়ী হয়ে ভারমুক্ত হওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয়ই আছে তার।