ছবি বিশ্বাসের ভয়াবহ মৃত্যুর কথা, কী হয়েছিল অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে?

তারিখটা ছিল ১৯৬২ সালের ১১ জুন। লোকে লোকারণ্য কলকাতার আর্জিকর হাসপাতাল। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার মানুষটি দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতেই আনা হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানান দুর্ঘটনাস্থলেই মারা হয়েছেন তিনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ঘোষণা করেছিলেন মৃতদেহের ময়না তদন্ত হবে না। হাসপাতাল থেকে উত্তম কুমার সহ সেসময়কার জনপ্রিয় অভিনেতাদের কাঁধে চেপে স্টার থিয়েটারে আসেন ছবি বিশ্বাস (Chhabi Biswas)। সেইদিন একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলা। পিতৃহারা হয়ে যায় বাংলা সিনেমা।

১৯০০ সালের ১৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। বারাসাতের জাগুলিয়া জেলায় জমিদারি ছিল দে বিশ্বাস পরিবারের। জানা যায় দে ছিল তার পদবী এবং বিশ্বাস উপাধি তার পূর্বপুরুষরা পেয়েছিলেন বাদশা আকবরের কাছ থেকে। বাবা ভূপতিনাথ দে বিশ্বাসের চার ছেলের মধ্যে ছোটছেলে শচীন্দ্রনাথ, বয়সের একধাপ পেরোতেই হারান মাকে। প্রিয় দর্শক ছেলেটিকে মা ডাকতেন ছবি বলে, সেটাই রয়ে গেল আজীবন ইতিহাসের পাতায়। হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং শেষে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন ছবি বিশ্বাস।

শিশিরকুমার ভাদুড়ির হাত ধরেই নাট্য জগতে প্রবেশ ঘটেছিল তার। নদের নিমাই নাটকে গৌরাঙ্গের চরিত্রে তার অভিনয় সেইসময় প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল দর্শকদের মাঝে। তারপর হঠাৎই নাট্য জগৎ থেকে বিরতি নিয়ে তিনি যোগ দান করেন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। একসময় করেছিলেন পাটের ব্যবসাও। তবে রঙ্গমঞ্চের হাতছানি কোনভাবেই এড়াতে পারেনি তিনি, ফিরে আসেন নাট্য জগতে।

১৯৩৬ সালে অভিনেতা পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী অন্নপূর্ণা সিনেমায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাসকে। যদিও লম্বা সুদর্শন নাটকটিতে মেনে নেন দর্শকরা। তারপর এগিয়ে ওদিক অনেক ঘুড়েছিলেন কাজের আসায়। একসময় পরবর্তী সময়ে নিউ থিয়েটার ছবিতে রেগুলার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তারপরই কাজ করেন নদের নিমাই, চোখের বালি এবং প্রতিশ্রুতি সিনেমায়। দেবকুমার বসুর নর্তকী সিনেমায় এক ৯০ বছরের বৃদ্ধের ভূমিকায় তার অসাধারণ অভিনয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে আজও। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৪০। যদিও নর্তকী সিনেমায় অভিনয় করে লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতিই হয়েছে তার। কারণ তারপর আর তাকে কেউ সুযোগ দেননি নায়কের ভূমিকায়।

তিনি সারাজীবন রয়ে গেলেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই। ১৯৫৪ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গল্প অবলম্বনে জলসাঘর সিনেমাটি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখন হুরুজের চরিত্রে তার প্রথম পছন্দই ছিলেন ছবি বিশ্বাস। এরপর দেবী এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমাতেও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। পরশপাথর ছবিতেও ক্যামিও চরিত্রে নজর কেড়েছিলেন তিনি। মূলত বাবার চরিত্রে অভিনয় করলেও তাকে কেন্দ্র করে নির্মিত কাবুলিওয়ালা মতো সিনেমাতেও দর্শকদের মাঝেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যদিও এত বড় অভিনেতা হয়েও সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার ছাড়া তেমন কোন বড় পুরস্কার পাননি তিনি।

১৯৬২ সালের সেই দিন পরিবারের সঙ্গে দমদম থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। ড্রাইভারকে সরিয়ে তিনিই চালাতে শুরু করেন গাড়ি। মধ্যমগ্রামের কাছে রাস্তায় উল্টো দিক থেকে আসা একটি ভ্যান সজোরে ধাক্কা মারে গত গাড়িটিকে। ঘটনাস্থলেই দুমড়ে মুচড়ে যায় গাড়ি, স্টিয়ারিং এসে ধাক্কা মারে বুকে। গাড়ির অন্যান্য যাত্রীদের কোন ক্ষতি না হলেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। সেদিনের ওই দুর্ঘটনা কেড়ে নে ছবি বিশ্বাসকে। ছবি হারা হয়ে বাংলা সিনেমা। তবে আজও তিনি নিজের সিনেমার মাধ্যমে অমর হয়ে রয়েছেন দর্শকদের মনে। তার জন্মদিনে তাকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Latest articles

Related articles

spot_img